এখন পর্যন্ত মহাকাশ স্টেশন গুলোর মধ্যে মানুষ বসবাস এর উপযোগী এক মাত্র মহাকাশ স্টেশন হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন।দীর্ঘ সময় টিকে থাকা মহাকাশ স্টেশন গুলোর মধ্যে এটি একমাত্র মহাকাশ স্টেশন এর আগের দখলটি ছিল রুশ উপগ্রহ এম আই আর এর দখলে।যার সংক্ষিপ্ত রুপ “মি” এবং রুশ উপগ্রহের সময়কাল ছিল প্রায় ১০ বছর।
এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে আপনাদের সাথে এই নবম কৃত্রিম উপগ্রহ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন কী?
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন হলো একটি কৃত্রিম উপগ্রহ।আর একে কৃত্রিম উপগ্রহ বলা হয় এই কারণে যে এটি মানুষের তৈরী গ্রহ।যেটি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এর বিঞ্জানীর নিরলস পরিশ্রমের ফল।এখন পৃথিবীর বাইরের এক মাত্র উপগ্রহ হলো এই মহাকাশ স্টেশন যেটি মানুষ বসবাসের জন্য উপযোগী।এটি এক ওজন বিহীন জায়গা।
এটি সম্পূর্ণ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাহিরে অবস্থিত যেখানে মধ্যাকর্ষণ বল এতটাই হালকা যে সেখানে শূন্য থেকে কয়েকশ টন এর বেশি ওজনের জিনিসও বা তার চেয়ে বেশি ওজনের জিনিসও ভেসে বেড়ায়।এখানে ওপর নিজ বা দিন রাত এর কোনো হিসাব নেই।
মহাকাশ স্টেশন তৈরীর ইতিহাস:
মহাকাশ স্টেশন তৈরীর মাধ্যমে বিঞ্জানীরা এক অসাধ্য সাধন করেছে কারণ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এমন এক সময়ে তৈরীর কাজ শুরু হয়েছিল যখনকার কম্পিউটার গুলো ছিলো বর্তমানের মোবাইলের থেকেও কম শক্তিশালী।এমন সময়ে এমন একটি স্থাপণা তৈরীকে বিঞ্জানের অসাধ্য সাধন ও বলা যায়।
১৮৬৯ সালে এভরট হেল প্রথম এই মহাকাশ স্টেশন নির্মাণ এর পরিকল্পনা করলেও পরে বিংশ শতকের প্রথম দিকে তিশোলকোভস্কি ও হারমান ওবের্থ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যোগ করেন।
১৯২৯ সালে হার্মান পোটকনিক “The Problem of this Space Travels” বইতে সম্ভাব্য মহাকাশ স্টেশন এর নকশা প্রকাশ করেন।এরপর বহু সময় আর পরিশ্রমে এটি বাস্তবে রুপান্তরিত করতে অনেক সময় ও মেধাশ্রম দিতে হয়েছে।
১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাকাশ প্রকল্প হাতে নেয়।যার নাম দেওয়া হয় স্পেস স্টেশন ফ্রিডম।কিন্তু আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এর মাস্টার প্লেন ও নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি।
পরবর্তী অন্যান্য কিছু দেশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কাজ শুরু করে।একাধিক দেশ এর সহযোগিতার কারণে ১৯৯৩ সালে এর নাম দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন – International Space Station (ISS). এরপর আরও বহু চ্যারেঞ্জ মোকাবিলা করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন – International Space Station (ISS) আজকের অবস্থায় এসে দাড়িয়েছে।এরপরও এই মহাকাশ স্টেশন প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে।মনুষ্য নির্মাণের এটি সবচেয়ে বড় স্থাপনা।
এই স্টেশন পুরোটা একবারে তৈরী করে অথবা সেখানে তৈরী করা সম্ভব নয় বলে পৃথিবী থেকে খন্ড খন্ড করে তৈরী করে নিয়ে সেখানে যুক্ত করা হয়েছে।মহাকাশ স্টেশন এর একাধিক খন্ড বা মডিউল তৈরী করা হয়েছে এশিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার একাধিক দেশ এর সহায়তায়।মডিউল গুলোকে নির্মাণ করে মহাকাশে পৌছানোর কাজে ব্যাবহার করা হয়েছে তিন ধরণের রকেট।এগুলো হলো: আমেরিকার স্পেস শাটল, রাশিয়ান প্রোটন রকেট ও রাশিয়ার সৈয়োজ রকেট।
হাবল টেলিস্কোপ (বিস্তারিত)
এই মহাকাশ স্টেশনটি তৈরী করতে ১৩ বছরেরও বেশী সময় লেগেছে।এই স্টেশন নির্মাণ এর কাজটি শুরু হয়েছিল আমেরিকান ও রাশিয়ান দুটি স্টেশনকে মহাকাশে সংযুক্ত করার মাধ্যমে।দুটি দেশের প্রযুক্তি ভিন্নতার কারণে কোনো ভাবে দুটি স্টেশনকে সহজে সংযুক্ত করা যাচ্ছিল নাহ।পরবর্তীতে এ দুটি ভিন্ন প্রযুক্তির স্টেশনকে একত্রে করতে নির্মাণ করা হয় এক বিশেষ ধরণের কনভার্টার যার নাম হলো প্রেসারাইজড মেটিং এডাপটার সংক্ষেপে এর নাম পিএমএ (P.M.A)।
১৯৯৮ সালে প্রেসারাইজড মেটিং এডাপটার বা পিএমএ এর মাধ্যমে মহাকাশ স্টেশন দুটিকে যুক্ত করা হয় কিন্তু তখন ও পর্যন্ত এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নভোচারীদের বসবাস এর উপযোগী ছিল নাহ।তারপর থেকে 2000 সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ হয় এই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এর এবং ঐ বছর ২০০০ সালের নভেম্বর মাস এর পর থেকে মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা বসবাস শুরু করে।এবং ঐ সময়ের পর থেকে মহাকাশ স্টেশন কখনো জন শূন্য হয় নি।স্বার্বক্ষণিক ভাবে ৬ জন নভোচারী ৬ মাস করে মহাকাশ স্টেশনে বসবাস করে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন তৈরীর উদ্দেশ্য:
এই স্টেশন এর ফলে ভবিষ্যতে আরও গভীরে গবেষণা চালানোর জন্য যেসব সমস্যা হতে পারে সেসকল সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছে এইখান থেকে বিঞ্জানীরা এবং মহাকাশ সম্পর্কে আরও নতুন নতুন তথ্য জানতে পাচ্ছি।
স্বার্বক্ষণিক ভাবে ৬ জন নভোচারী মহাকাশ স্টেশনে বসবাস করে আসছে।তাদের সেখানে বসবাসের উদ্দেশ্য হলো এমন সব গবেষণা করা যেগুলো পৃথিবী থেকে করা সম্বভ নয়।আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে সাধরণত প্রত্যেক নভোচারীর অবস্থান এর সময় ৬ মাস কিন্তু কোনো নভোচারীকে বছর খানেক এখানে থাকতে হয়।এছাড়াও পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মানব শরীরে কী কী পরিবর্তন আসে সেগুলো পরীক্ষা করা হয়।
মহাকাশ স্টেশন এর আয়তন, আকার ও আকৃতি
নির্মাণ কাজ শেষে এই উপগ্রহটির ওজন হয় ৪ লাখ ২০ হাজার কিলোগ্রাম।সবগুলো সোলার সম্প্রসারণ অবস্থায় এর দৈর্ঘ্য দাড়ায় প্রায় ২৪০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৩৬০ ফুট।
অথবা বলতে পারি
এই মহাকাশ স্টেশন এর দৈর্ঘ্য একটি ফুটবল মাঠের সমান এবং এর ভিতরের পরিসর ৬ বেড রুম একটি বাসার সমান।
এছাড়াও ভিতরে নভোচারীদের বসবাস এর জন্য রয়েছে ৬ টি শোবার ঘর, ২টি বাথরুম, একটি শরীর চর্চা কেন্দ্র এবং স্বচ্ছ কাচের বৃত্তাকার একটি ঘর।
এই স্টেশনটির বা উপগ্রহটির গতিপথ এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে এতে বসে নভোচারীরা পৃথিবীর অপরুপ সুন্দর্য উপভোগ করতে পারে আর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে আপনি যদি দেখতে চান তাহলে এই সাইটটি ভিজিট করতে পারেন।
মহাকাশ স্টেশন এর অবম্থান:
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ট থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।এটিকে বিঞ্জানের ভাষায় লো আর্থ অরবিট নামে পরিচিত।ভূপৃষ্ট থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমন্ডল শেষ হওয়ার পর থেকে শুরু হওয়া অরবিট কক্ষ পদটির সর্বোচ্চ সীমা ভূপৃষ্ট থেকে ২৫০০ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত।
আন্তর্জাতিক স্টেশন থেকে গবেষণা করা দেশ গুলো
বর্তমানে ১৫টি দেশ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে তাদের গবেষণা ও কার্যক্রম পরিচালনা করে।এখানে কাজ করা দেশ গুলো হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা জাপান রাশিয়া এবং ইউরোপিয় এজেন্সির অধীনে থাকা ১১ টি দেশ।ইউরোপীয় এজেন্সির দেশ গুলো হলো যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, নরওয়ে, সুইডেন. ইতালি, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ও ডেনমার্ক।
বহুদেশ এর দক্ষ গবেষদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এটি একটি অন্তর্জাতিক বিঞ্জান গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে।৩ দশকেরও বেশি সময়ে প্রায় সাড়ে তিনশ নভোচারী এই অন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কাজ করেছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এর দূর্ঘটনা
অতীতে মহাকাশ স্টেশন থেকে ফিরে আসার সময় দুইটি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নভোচারী মারা যায়।এ দুর্ঘটনার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি সকল ধরণের পূর্ব প্রস্তুতি থাকলেও প্রতিটি মহাকাশ ভ্রমণে রয়েছে দূর্ঘটনার ঝুকি।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এর গতি?
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতি ঘন্টায় প্রায় ২৮ হাজার দূরত্ব অতিক্রম করে।আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) এর পুরো পৃথিবীকে অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় ৯২ মিনিট।এই গতির কারণে এই উপগ্রহে অবস্থানরত নভোচারীরা প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৬ বার সূর্যদ্বয় ও সূর্যাস্তের সুযোগ হয়।এই মহাকাশ স্টেশন তুলনামূলক পৃথিবীর খুব কাজ দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তাই ঘুরতে ঘুরতে যদি বায়ুমন্ডলে ঢুকে পড়ে তাহলে অভিকর্ষণ বলের কারণে বায়ুমন্ডলে প্রচন্ড বেগে আসার সময় এটিতে আগুন জ্বলে যাবে যাতে এমন কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য এটিকে নির্দীষ্ট সময় পর পর বিশেষ প্রযুক্তির মাহায্যে এটিকে ঠেলে উপরে পাঠানো হয়।যাতে করে স্টেশন তার নিজস্ব কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে পারে।
এই উপগ্রহটি পৃথিবী খেকে দেখার উপায়
৪০০ কিলোমিটার দরত্ব পৃথিবী থেকে বেশি মনে হলেও চাঁদ ও সর্যের তুলনায় খুবই অল্প।তাই আপনি চাইলেই এই উপগ্রহটি খালি চোখে দেখতে পারবেন তবে তার জন্য উপযুক্ত সময় জায়গা ও পরিষ্কার আকাশ প্রয়োজন।সৌখিন টেলিস্কোপ থাকলেতো কথায় নেই তবে খালি চোখে দেথতে চাইলেই সূর্যদ্বয় এর আগের সময়টা উপযুক্ত।এই মহাকাশ স্টেশনটি কখন আপনার মাথার উপরে থাকবে সেটি জেনে নিতে পারবেন নিচের ওয়েবসাইট থেকে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এর নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন মহাকাশ স্টেশনটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় পৃথিবী থেকে সর্বমোট ৪৪ কম্পিউটার এর সাহায্যে।পানি উৎপাদন, অক্সিজেন উৎপাদন, এর ভিতরের আদ্রতা ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাবহ্রত সোলার এর দিক নিয়ত্রণ সহ যাবতীয় কাজই করা হয় সবই করা হয় সফটওয়্যার এর সাহায্যে।এইসব নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থার কাজে যেই সফটওয়্যার গুলো ব্যাবহার করা হয়েছে সেই সফটওয়্যার গুলো তৈরী করতে কোড লিখতে হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ লাইন।আর এর ভিতরে বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থা সচল রাখতে যে তার ব্যাবহার করা হয়েছে সব গুলোর একত্রে মোট দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার এরও বেশি।এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যম হচ্ছে বাহিরে থাকা ৮ টি সোলার সিস্টেম এর মাধ্যমে।যার সাহায্যে ৭৫ থেকে ৯০ কিলো ওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
এছাড়াও ঘূর্ণনের সময় যদি এর আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তন করতে চাইলে উপগ্রহটির সাথে সংযুক্ত ইঞ্জিনগুলো ব্যাবহার করা হয়।যা এর ভেতরের নভোচারীরা করে থাকে।আর সেগুলো ত্রুটিযুক্ত হলে সেগুলো ত্রুটিমুক্ত করতে স্পেসওয়ার্ক করতে হবে।তারা বিশেষ প্রতিরক্ষা স্যুট পরা অবস্থায় মহাকাশে ঘুরে ত্রুটি মেরামত করেন।নভোচারী এমন ২ শতাধিক কাজ সম্পূর্ণ করেছেন গত দুই দশকে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন নভোচারী পাঠানো দেশ গুলো হলো:
এখন পর্যন্ত এই মহাকাশ স্টেশনে মোট ১৯ দেশের ২৩৯ জন নভোচারী বসবাস করেছে।এর মধ্যে ১৫১ জন নভোচারী যুক্তরাষ্ট্রের, ৪৭ জন নভোচারী পাঠিয়ে রাশিয়া ২য় স্থানে রয়েছে।জাপান ৯ এবং কানাডা ৮ জন নভোচারী, ইতালি ৫, ফ্রান্স এর ৪ এবং জার্মানীর ৩ জন নভোচারী এই মহাকাশ স্টেষনে বসবাস করেছে।মহাকাশ স্টেশনে নভোচারী দের মধ্যে সবচেয়ে বসবাস করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পেগি হুইটসন (Peggy Whitson) (সেপ্টেম্বরের ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬৬৫ দিন)।

ধন্যবাদ